Appendix II

ব্যাকরণের সন্ধি

[১৩১৮ বঙ্গাব্দের সাহিত্য-পরিষৎ পত্রিকা হইতে পুনর্মুদ্রিত]


একজন লোক নিজের রচনায়, কেমন করিয়া শব্দগুলিকে সন্ধির বন্ধনে বাঁধিয়া লইবে, ইহার শিক্ষার জন্য ব্যাকরণ নয়। যে সকল রচনায় সন্ধি-বন্ধন আছে, সেখানে কি উপায়ে পদবিচ্ছেদ করিয়া মূল শব্দগুলিকে চিনিয়া লইয়া অর্থ করিতে হইবে, তাহার শিক্ষার জন্যই ব্যাকরণের সূত্র। ব্যাকরণ শব্দের অর্থ হইতেই তাহা সূচিত হয়। ব্যাকরণে ব্যুৎপত্তির জ্ঞান হয়,—বিশ্লেষণপ্রণালীর শিক্ষা হয়। পদে পদে সন্ধি যোগ না করিয়া যদি কেহ সংস্কৃত গদ্য রচনা করেন, তবে তাঁহার রচনাকে কেহ দোষযুক্ত বলিতে পারেন না। ব্যাকরণে এমন সূত্র নাই যে সন্ধিযোগ না রাখিলে রচনা অশুদ্ধ হইবে। শব্দের রূপ বা ধাতুর রূপ, স্বতন্ত্র কথা। যে রূপ ধারণ করিলে শব্দের যে অর্থ হয়, কিংবা ক্রিয়াপদে যে কাল বুঝায়, তাহা হইল ভাষার মূল কথা; তাহা না মানিলে কোন পদের বা কোন শব্দের অর্থই হয় না। সন্ধি যোগ করা বা না করা, লেখকের সুবিধার কথা; উহা যে 'পুরুষেচ্ছয়া,' তাহার প্রাচীন উল্লেখ আছে। যেখানে সন্ধি যোগ হয়, সেখানে যে তাহা করিতেই হইবে, এটা হইল অর্ব্বাচীন যুগের সংস্কৃত রচনার একটা অস্বাভাবিক পদ্ধতি।

মানুষের প্রতিদিনের কথা কহিবার ভাষায় সন্ধিবন্ধনের কড়া নিয়ম থাকিতে পারে না; স্বাভাবিক উচ্চারণের সুবিধায় যতটুকু সন্ধির বাঁধন পড়িয়া যায়, ততটুকুই থাকে। বাঙ্গালায় আমরা গোলালু, মশারি প্রভৃতি যেমন বলি, বৈদিক ভাষা বা ছান্দসেও তাহাই দেখিতে পাই। যখন সন্ধিবাঁধনের কড়া নিয়মের যুগে বৈদিক ঋক্‌গুলির পদে পদে সন্ধি জুড়িয়া পুঁথি লেখা চলিতেছিল, তখন 'পদপাঠের' সৃষ্টি। সন্ধি জুড়িলে বৈদিক ছন্দ এবং সুর নষ্ট হইয়া যায় বলিয়া, 'পদপাঠে' যেখানে সন্ধি নাই, গোড়ায় সেখানে সন্ধি ছিল না বলিয়া বুঝিতে হইবে। অনেক স্থলে যে সন্ধি করিতে গেলে অক্ষর কমিয়া গিয়া ছন্দ নষ্ট হয়, তাহার অনেক দৃষ্টান্ত আছে। বৈদিক ঋক্‌গুলির কেবল পদপাঠ দেখিলেই সকলে উহা বুঝিতে পারিবেন।

ছান্দস হইতেই সংস্কৃত ভাষার উৎপত্তি; কিন্তু হয়ত এই ভাষা খৃষ্টাব্দের প্রথম শতাব্দীর পূর্ব্বে 'সংস্কৃত' নাম পায় নাই; পালি সাহিত্যে অপ্রচলিত Classical ভাষাকে ছান্দস-ই বলা হইয়াছে; বিনয় পিটকের চুল্লবগ্‌গের একটি উল্লেখে উহা সুস্পষ্ট। ১৪০ খৃঃ পূর্ব্বের মহাভাষ্যেও সংস্কৃত শব্দ ভাষা অর্থে পাওয়া যায় না। যখন হইতে ভাষার নাম "সংস্কৃত" পাওয়া যায়, তখন হইতেই উহাতে জটিল রচনার পরিচয় পাই। সন্ধির ঘটা, সমাসের বাহুল্য প্রভৃতি ত আছেই, তাহা ছাড়া অনেক স্থলেই এমন ভয়ঙ্কর দুরন্বয় যে, অনেক টানিয়া হেঁচ্‌ড়াইয়া পদে পদে যোগ করিয়া অর্থ করিতে হয়। ইহাতেই বুঝিতে পারা যায় যে, সংস্কৃত কেবল একটা সাহিত্যের ভাষা হইয়া দাঁড়াইয়াছিল; উহা কথাবার্ত্তার ভাষা ছিল না। যে সময়ে ঐ ভাষাটির নাম হইয়াছিল 'সংস্কৃত,' তাহার বহুপূর্ব্ব হইতেই এদেশে অনেকগুলি 'প্রাকৃত' বা লোকব্যবহারের স্বাভাবিক ভাষা ছিল। সেই সকল স্বাভাবিক ভাষা বা প্রাকৃত ভাষাও ছান্দস হইতে উৎপন্ন হইয়াছিল। লোকব্যবহারের ভাষা যখন পণ্ডিতিধরণে ঘষিয়া মাজিয়া লওয়া হইয়াছিল, এবং ছান্দস বা বৈদিকে অব্যবহৃত অনেক নূতন জিনিষ আমদানি করা হইয়াছিল, তখনই ঐ ভাষার নাম হইয়াছিল সংস্কৃত বা সংস্কার-পূত। যে ভাষা সাধারণ লোক-ব্যবহারে অপ্রচলিত ছিল, তাহা যে ব্যাকরণের নির্দ্দিষ্ট সংখ্যক কড়া নিয়মের মধ্যে আবদ্ধ হইবে, তাহার আর বিচিত্র কি? সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞান প্রভৃতি সমস্তই সংস্কৃতে রচিত হইত; কিন্তু লোকে কথাবার্ত্তা কহিত আপনাদের দেশপ্রচলিত প্রাকৃত ভাষায়।

সংস্কৃতের সন্ধির সূত্রগুলি হইতে ঐ ভাষার অর্ব্বাচীনতা এবং প্রাচীনতর ভাষাগুলির প্রকৃতি, কিছু কিছু বুঝিতে চেষ্টা করিব।

বর্ণমালার মধ্যে স্বরবর্ণ বলিয়া যে শ্রেণীবিভাগ, ওটা হইল ভাষার একটা বিজ্ঞান হইবার সময়কার সৃষ্টি। স্বতন্ত্র ও স্বাধীন অ, আ প্রভৃতির উচ্চারণ ত ছিলই, তাহার পর আবার বর্ণগুলির স্থায়ী উচ্চারণ, আওয়াজ বা স্বরের সহিত ঐ অক্ষরগুলির আওয়াজের সমতা ধরিয়া লইয়া বর্ণগুলির নাম হইল স্বরবর্ণ। 'আ' অকারের দীর্ঘ উচ্চারণ হইলেও, অন্য দীর্ঘ উচ্চারণের সহিত উহার একটু পার্থক্য আছে। কিন্তু দ্রাবিড়ী উচ্চারণ ধরিলে ই, ঈ-র মতই অ এবং আ বর্ণের উচ্চারণে দীর্ঘতার ভেদই পাওয়া যায়। দক্ষিণপ্রদেশের উচ্চারণের হিসাবে 'আ'কারকে যথার্থই 'অ'কারের একটু দীর্ঘ উচ্চারণ মাত্র পাই। প্রাচীনকালে সেইরূপই ছিল; তবে বৈদিকে কোন কোন স্থলে 'আ'কারের প্রায় হ্রস্ব উচ্চারণ আছে। আর 'অ' বর্ণটি ও স্থলে স্থলে সংবৃত উচ্চারণে প্রায় বাঙ্গালা উচ্চারণের মত ছিল।

ঋ এবং ঌ কিরূপে উচ্চারিত হইত যে উহারা স্বরসংজ্ঞা পাইয়াছিল, তাহা অল্পে বুঝাইয়া লেখা শক্ত। এখনও উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে ঋ-র উচ্চারণ প্রায় 'এর' ও প্রাচীন Iraniতে অর্-এ উচ্চারণই ধরা যায়। ঋকারান্ত শব্দের বিকৃতিতে, প্রাচীন কালের প্রাকৃত ভাষায় উ এবং ই উভয়বিধ আওয়াজই ধরিতে পারা যায়; কি কারণে উহা ঘটে, তাহা স্বতন্ত্র প্রবন্ধে লিখিব; বিকৃতির 'উ' দেখিয়া ঋ কারের দ্রবীড়ি উচ্চারণকে ঠিক মনে করা ভূল।

স্বরবর্ণের উচ্চারণভেদে প্লুতসংজ্ঞা নির্দ্দেশ দেখিয়া, মান্দ্রাজ প্রদেশের "এ" "ও" প্রভৃতির দীর্ঘ উচ্চারণের একটা প্রাচীন মূল ছিল বলিয়া স্বীকার করিতে হইবে। পাণিনির ৮।২।১০৬ এবং ৮।২।১০৭ সূত্র হইতে ইহা সুস্পষ্ট হইবে। বৈদিক ছন্দের পাঠে এই প্লুত উচ্চারণ যথেষ্ট আছে, ঐ সকল উচ্চারণ ধরিয়া বিচার করিলে "এ" এবং "ও"কে যুক্তস্বর বলিতে হয়। বৈদিক ব্যাকরণে ঐ, ঔ, চারিমাত্রাবিশিষ্ট (সিদ্ধান্তকৌঃ বৈঃ প্রঃ ৩৬২৫ সূ)।

"এ" যেন অ + ই অথবা আ + ই মিলিত হইয়া উচ্চারিত; উচ্চারণ এক্‌টু তাড়াতাড়ি করিতে হয়, নহিলে "ঐ"কারের মত ধ্বনি হয়। ঐরূপ আবার "ও"কারটি যেন "অ" বা "আ" পরস্থিত "উ"র মিলিত ধ্বনি। অকার কিম্বা আকারের সহিত "এ" যুক্ত হইলে যে উচ্চারণ হয়, তাহা হইল "ঐ"; এবং "ও" যুক্ত হইলে হইল "ঔ"। এই উচ্চারণ যে সন্ধির নিয়মের সঙ্গে মিলিয়া যায়, তাহা পাঠকেরা বেশ দেখিতে পাইতেছেন।

এই উচ্চারণ বা স্বরবর্ণের স্বাভাবিক আওয়াজ হইতেই দেখিতে পাইতেছি যে, পদগুলি উচ্চারণ করিতে গেলে স্বভাবতঃ যাহা ঘটিত, অনেকগুলি স্বরসন্ধির সূত্রে তাহাই বিধিবদ্ধ। যথা—"অকারের পর আকার থাকিলে উভয়ে মিলিয়া আকার হয়; অকারের পর ইকার থাকিলে একার হয়, উকার থাকিলে ওকার হয়; অ কিম্বা আকারের পর এ কিম্বা ও থাকিলে যথাক্রমে ঐ কিম্বা ঔ হয়; ইত্যাদি।" উচ্চারণ যদি প্রাচীনকালের মত থাকিত, তবে এই সন্ধির সূত্রগুলি কাহাকেও মুখস্থ করিতে হইত না। বলিয়া দিলেই হইত যে, ভিন্ন ভিন্ন উচ্চারণ মিলিত হইলে যুক্ত উচ্চারণকেই স্বাতন্ত্র্য বা প্রাধান্য দিতে হইবে।

দুইটি আওয়াজ এক সঙ্গে মিশিলে একটা মিশ্র আওয়াজ হইবেই; সাধারণতঃ শেষের আওয়াজটি প্রথমটিকে ঢাকিয়া ফেলে, অথবা একটু হ্রস্ব বা মন্দীভূত করিয়া দেয়। সন্ধির নিয়মে সর্ব্বত্র তাহাই। এই নিয়মটি সম্বন্ধে দু' একটি কথা পরে বলিতেছি। এখন ঋ-কারের সন্ধির বিচার করি। প্রথমেই বলিয়াছি, যে "ঋ" ও "ঌ" প্রথমে কিরূপে উচ্চারিত হইত, তাহা এখন কোন প্রদেশের উচ্চারণ হইতেই ধরা যায় না। আকারের পর ঋ থাকিলে, আকারটি একটু খর্ব্ব হইয়া "অ" হইয়া গেল, তাহা না হয় বুঝিলাম। কিন্তু মিলিত উচ্চারণটি "অর্" হইল কেন? ইহাতে মনে হয় ঈরাণীর মত ঋ-কারের উচ্চারণ "অর্" ছিল। যদি সহজ "রি" কিম্বা "রু" উচ্চারণ থাকিত, তাহা হইলে শেষের স্থায়ী আওয়াজটি "ই" বা "উ" হইত। স্বতন্ত্র স্বরবর্ণ হইত না। ঋ-কারের স্থানে অনেক স্থলে যেমন "অর্" হয়, তেমনি আবার "ইর্"ও হইয়া থাকে; কিন্তু বৃদ্ধির নিয়মের সূত্রটি বিশ্লেষণ করিলে দেখিতে পাই যে, সন্ধির নিয়মে স্বরগুলির যেরূপ বিকৃতি ঘটে, স্বরের বৃদ্ধিতেও ঠিক তাহাই ঘটে; তখন "ঋ" স্থানে "আর্" দেখিয়া সন্ধির উচ্চারণের "অর্"ই ঋ-কারের আদিম উচ্চারণ বলিয়া মনে হয়। একে "অর্" ঠিক 'র' নয়, তাহার পরে আবার অন্তঃস্থ বর্ণগুলি যে ব্যাকরণের বৈজ্ঞানিক নিয়মের প্রভাবে সৃষ্ট নূতন বর্ণ মাত্র, তাহাও দেখাইতেছি।

এই প্রসঙ্গে একথাও বলিয়া রাখি, ঋ-কারের অর্ উচ্চারণ ছিল মনে করিয়া লইলে বৈদিক ব্যাকরণের দুই একটি স্থলের ঋ-কারের বিকৃতি স্বাভাবিক নিয়মে ধরিতে পারা যায়; তাহার জন্য সূত্র গড়িতে হয় না। পাণিনির "বিভাষর্জোশ্‌ছন্দসি" সূত্রের ব্যাখ্যায় পাই যে, বৈদিক ভাষায় যদি ইষ্ঠ, ইমন্, ঈয়স্ প্রত্যয় পরে থাকে, তাহা হইলে "ঋজু"র ঋকার র হইয়া যায় (সিঃ কৌঃ বৈদিক প্রকরণ ৩৫৫৫ সূ)।

অন্তঃস্থ বর্ণগুলি (অর্থাৎ য, র, ল, ব) যে মৌলিক বর্ণ নয়, স্বরমিশ্রণে উৎপন্ন, তাহা দেখাইতেছি। "য"এর উচ্চারণ হইল "ইঅ"; বাঙ্গালা এবং ওড়িয়া ছাড়া এখনো সর্ব্বত্রই ঐ প্রকার উচ্চারণ হইয়া থাকে। আমরা 'য'এর 'জ' উচ্চারণ করি বলিয়া, "ইঅ" উচ্চারণের জন্য 'য'এর নীচে ফোঁটা দিয়া থাকি। "উহ্য" শব্দটিকে আমরা উচ্চারণ করি, "উজ্‌ঝ," আর অন্য প্রদেশে উহার উচ্চারণ "উ-ই-হ"। ই + অ উচ্চারণ সংযোগে যেমন 'য,' উ + অ উচ্চারণ সংযোগে ঠিক তেমনি অন্তঃস্থ ব। সন্ধির সূত্রগুলিতেও, য এবং ব কেবল উক্ত স্বর সংযোগ, আর কিছু নহে।

যে নিয়ম য এবং ব সম্বন্ধে খাটিতেছে, ঐ নিয়মেই র, ল শাসিত। 'ঋ'র পরে স্বরবর্ণ থাকিলে যখন 'র' হয়, তখন 'র'কারের উৎপত্তি 'য' এবং 'ব'এর মত বলিয়া মনে করা সঙ্গত। এরূপ অবস্থায় ঋ এবং ঌ-কারের প্রাচীন কালের যেরূপ উচ্চারণ ছিল বলিয়া মনে করিয়াছি, তাহা সঙ্গত হইবার সম্ভাবনাই খুব অধিক।

যখন দুইটি স্বর বা আওয়াজ মিলিলে একটা স্বাভাবিক মিশ্র আওয়াজ হয়, তখন শেষের আওয়াজটি বেশী তীব্র হইলে প্রথম আওয়াজটিকে একেবারে ঢাকিয়া ফেলিবে, আর বেশী তীব্র না হইলে প্রথম স্বরটিকে একটুখানি হ্রস্ব বা মন্দীভূত করিয়া দিবে। কারণ দুটি স্বর সমান প্রাধান্য রাখিয়া উচ্চারিত হইতে পারে না। একারের উচ্চারণ অ + ই জাত কাজই শে (শ + অই) + অন হইতে শয়ন হইবে; শেষের ই + অ যোগে 'য়' হইয়াছে। আবার ঐরূপ ঐ অক্ষরটি আ + ই বলিয়া, বিনৈ + অকঃ হইল বিনায়কঃ। অ মাঝে পড়িলে 'য়' উচ্চারিত হইত, দৃষ্টান্তস্বরূপ 'সখা আগচ্ছ' "সখায়াগচ্ছ" এই বিকল্পের রূপ দুইটি লক্ষ্য করিলেই চলিবে। প্রাকৃত ভাষায় কিন্তু এসকল স্থলে 'য়' হয় না, 'অ'ই থাকে। কিন্তু প্রথমের আওয়াজে যদি বেশী জোর দেওয়া যায় (অর্থাৎ যদি তাহাতে Accent থাকে) অর্থাৎ উদাত্ত হয়, তাহা হইলে পরবর্ত্তী স্বরকে তেমনি আবার প্রায় লুপ্ত হইয়া যাওয়া চাই, শেষের স্বর বেশী দুর্ব্বল হইলে প্রথমের Accent-যুক্ত স্বরকে লোপ করিতে পারে না, বরং নিজে অর্দ্ধলুপ্ত হইয়া থাকে। যখন সম্বোধনের পদে, কবে, সখে, গুরো প্রভৃতি উচ্চারণ করা যায়, তখন ঐ শব্দ গুলির স্বরে যে Accent থাকে তাহা বুঝাইতে হইবে না। কাজেই সখে-অর্পয়, প্রভু-অনুগৃহাণ, প্রভৃতিতে যথার্থ সন্ধি না হইয়া কেবল 'অ'কারের অল্প উচ্চারণ রাখা হয় মাত্র। কিন্তু 'আ' 'ই' প্রভৃতি সুস্পষ্ট অথচ তীব্রস্বর পরে থাকিলে প্রথম নির্দ্দিষ্ট নিয়মই ঘটে। শে + অনম্ এবং সখে + ইহ প্রভৃতিতে সূত্র-পার্থক্য করিবার প্রয়োজন নাই; এই নিয়মের মধ্যে ধরিয়া লইলেই চলে। উ + উত্তিষ্ঠ, প্র + ঋজতে, অপ + ঋচ্ছতি, প্র + এজতে প্রভৃতি স্থলে বৈদিক ব্যাকরণে সন্ধি হয় না। পদপাঠে সর্ব্বত্রই ওগুলি স্বতন্ত্র থাকে; নহিলে ছন্দ পর্য্যন্ত বিগ্‌ড়াইয়া যায়। কেবল একটা সাধারণ সন্ধির সৃষ্টি করিয়া সকল শব্দকে এক নিয়মে বাঁধিবার অভিপ্রায়েই পরবর্ত্তী যুগে সন্ধির নিয়মের সৃষ্টি হইয়াছে। তবে, এক-স্বর-অব্যয়ে সন্ধি করিলে শব্দ বড় জটিল হইয়া পড়ে বলিয়া বৈদিক বিধিই রক্ষা করিয়া বিশেষ সূত্রে উ + উত্তিষ্ঠ প্রভৃতিকে অযুক্তই রাখা হইয়াছে। এখানে বিশেষ সূত্রই মৌলিক সাধারণ সূত্র।

সন্ধি করিলে যেখানে এক বচন দ্বিবচন বুঝিবার গোল হয়, কিম্বা একটা Accent নষ্ট হইয়া যায়, সেখানেও বৈদিক নিয়ম রক্ষা করিয়া সন্ধি যোগের সূত্র রচনা হয় নাই। তাই এখনো কবি + ইমৌ, অমী + অশ্বাঃ প্রভৃতি গোটাকতক পূর্ব্বকালের মত আছে।

ইহার পর বিসর্গের সন্ধির কথা বলিব। অন্য ব্যঞ্জন-সন্ধি অপেক্ষা সংস্কৃত ভাষাতত্ত্বে ঐটির বেশি প্রয়োজন আছে। কিন্তু বিসর্গের সন্ধির কথা বলিবার পূর্ব্বে কয়েকটি ব্যঞ্জনবর্ণের উচ্চারণের কথা বলিব। যে ভাষা 'সংস্কৃত' নামে আখ্যা পাইয়াছে, উহাতেই বিসর্গের একটা স্বতন্ত্র স্বাধীন উচ্চারণ পাওয়া যায় এবং সে উচ্চারণটি একালে অধিক পরিমাণে 'হ' বর্ণটির উচ্চারণের কাছাকাছি। এই স্বতন্ত্রতা থেকে উহা একটা বর্ণ বলিয়া গণিত হইয়াছে; নহিলে য, র, ল, ব প্রভৃতির মত উহারা বর্ণ সংযোগে জাত 'আওয়াজ' মাত্র। পাণিনি ব্যাকরণে ং ও ঃ (অথবা বিসর্জ্জনীয়) বর্ণমালার মধ্যে স্থান পায় নাই, পরে পাইয়াছে। ং এবং চন্দ্রবিন্দু অনুনাসিকের উচ্চারণ ভেদ মাত্র। যেখানে মিশ্র আওয়াজে অনুনাসিকের খর্ব্ব উচ্চারণ, সেইখানেই সন্ধির সূত্রে ং এবং ঁ। সাধারণ নিয়মে বলিতে গেলে স অক্ষরের স্থানবিশেষের উচ্চারণই বিসর্গ। 'র'জাত বিসর্গের কথা পরে বলিব। হয় ত প্রাচীনকালের উচ্চারণ পদ্ধতি আমাদের বাগ্‌যন্ত্রে অলক্ষে লাগিয়াছে বলিয়া, সাধারণ শ্রেণীর লোক কোথাও কোথাও 'দুঃখ' কথাটিকে 'দুস্‌খ' উচ্চারণ করিয়া থাকে। বিসর্গের সাধারণ মূর্ত্ত উচ্চারণ 'স'; শ, ষ, স তিনটির মধ্যে একটা সাধারণ আওয়াজ আছে, যাহার জন্য তিনটিই একনামে পরিচিত হইয়াছে সেই সাধারণ আওয়াজটুকু ভাবিয়া লইতে হয়, লিখিয়া বুঝান যায় না। তালু হইতে উচ্চারণ করিলে 'শ' যেরূপ উচ্চারিত হয়, তাহাতে যে ধ্বনিটি তেলেগু তামিলের 'চ' উচ্চারণের কাছাকাছি যায়, তবে 'শ' উচ্চারণটি আর একটু কঠোর রকমের ফিস্-ফিস্ আওয়াজের সহিত যুক্ত। তামিলে 'শ' একটু কোমল করিয়া উচ্চারণ করে বলিয়া 'চ' এবং 'শ'এ কোন প্রভেদ নাই; একই অক্ষর উভয়ের প্রয়োজন নিষ্পন্ন করে। পূর্ব্ববঙ্গের কোন কোন স্থানের চ ও ছও প্রায় তেলেগু তামিলের মত উচ্চারিত। সন্ধির নিয়ম দেখিয়া মনে হয়, পূর্ব্বকালে চ ছ প্রায় দ্রবিড়িধরণে উচ্চারিত হইত, উভয়েরই উচ্চারণ স্থান তালু। ষ টি উত্তর পশ্চিম প্রদেশে খ হইয়া গিয়াছে, আমরাও ক + ষ 'ক্‌খ' উচ্চারণ করি, আমাদের ভাষার জননী পালিতেও ঐ উচ্চারণ। প্রাচীনতর উচ্চারণে একটা গম্ভীর ধ্বনি সূচিত হইত। তাহার প্রমাণ দিতেছি। অতি প্রাচীন কালে, 'বৃ,' 'কং' 'ষ' প্রভৃতি দিয়া, যাহাকে 'অনমেটোপইটিক্' শব্দ বলে, তাহা গড়া হইত। য়থা;—বৃহ, বৃংহ, বৃংহতি; ঘোষ (ঘঃ ঘণ্টা অর্থে + ষ; ঘণ্টাতে আরও শব্দ যোগ আছে), মেষ ('মে' + ষ বা ধ্বনি) বৃষ, হ্রেষা, হর্ষ, ভাষ, মহিষ, রোষ (রু + ষ); কং (বা ক্বণ্) + ষ হইতে কাংস্য, জল শুকাইবার সময়কার শুষ্ ধ্বনি লইতে শুষ্‌ক ইত্যাদি। সিদ্ধান্তকৌমুদীর সঙ্গে মিলিতেছে না দেখিয়া হয় ত কেহ কেহ এ নূতন ব্যাখ্যায় বিরক্ত হইতেছেন। অভিনিবেশ করিলে বিরক্তির কারণ থাকিবে না। তবে আমার এ ব্যাখ্যা লইয়া যদি ললিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় একটুখানি রঙ্গরসের সৃষ্টি করিতে পারেন, তাহাতে আমি রাজি আছি। অর্ব্বাচীন সংস্কৃতে এবং একালের ভাষায় ভীম শব্দ বুঝাইবার অক্ষর হইল ড। ললিত বাবুর মত লোকেরা বলিতে পারেন যে, সেই জন্যই ভীমের স্ত্রী হিডিম্বা। বৈদিক প্রয়োগেও 'ড' দ্বারাও ষণ্ড প্রভৃতি কয়েকটি শব্দ পাওয়া যায়। বলিয়া রাখি যে, ঐ শব্দগুলি অতি প্রাচীন বৈদিক শব্দ নয়। আমরা যেমন কথা ডবল করিয়া কড়্ কড়্, হুড়্ হুড়্, ব্যবহার করি, সেরূপে ভাবপ্রকাশের প্রয়োজন হইলে বৈদিক সময়ে কেবল ষ একটু ঘন উচ্চারিত হইত। বলিয়া রাখি যে, ডবল্ না করিয়াও আমরা ড় দিয়া তীব্রতাব্যঞ্জক শব্দ বুঝাই; যথা—ঝড়, তোড়্ (বেগ অর্থে) দৌড় ('ধা' + ড়), মেড়, ভেড় (শেষ দুটি অর্ব্বাচীন সংস্কৃতেও ব্যবহার আছে) ইত্যাদি। প্রাসঙ্গিকরূপে অপ্রাসঙ্গিক কথা বলি নাই। "শব্দ" বুঝাইতে হইলে, আমরা মূর্দ্ধা হইতে উচ্চারিত বর্ণ দিয়া বেশি বুঝাইয়া থাকি। 'ষ' অক্ষরটির উচ্চারণ মূর্দ্ধা হইতে করিলে অনেক পরিমাণে প্রাচীন আওয়াজ পাওয়া যাইবে।

'স'টি মহারাষ্ট্রে সর্ব্বদাই বিশুদ্ধরূপে উচ্চারিত হয়; ওড়িয়া উচ্চারণও প্রায় ঠিক। "আস্তে" প্রভৃতি শব্দে আমরাও দন্ত্য উচ্চারণ কথঞ্চিৎ ঠিক রাখিয়াছি।

এখন বিসর্গের সন্ধির নিয়মগুলি কয়েকটি শ্রেণীতে বিভাগ করিয়া ফেলিয়া দেখাইতেছি যে, উচ্চারণের রীতি ধরিয়া লইলে বিনা সূত্রেই বিসর্গ সন্ধির সূত্র অধীত হইতে পারে। সূত্রের সুবিধার জন্য প্রথমতঃ বর্ণমালা হইতে ক খ এবং প ফ দূরে রাখিয়া দিব। বিসর্গের সাধারণ মূর্ত্ত উচ্চারণ 'স্'। প্রথমতঃ ঐ বিসর্গের পর চ, ছ; ট, ঠ; ও ত, থ থাকিতে পারে। তিনটি 'স' এর generalised একটা কিছু উচ্চারণ নাই বলিয়া কথাটা লিখিয়া বুঝাইতে কষ্ট হইতেছে। সেই তিন 'স' এর এক অভেদ মৌলিক আত্মাটি, চ, ছ-যুক্ত হইলেই 'শ' হইয়া ফুটিয়া উঠিবে; ট, ঠ যোগে ষ এবং ত, থ যোগে 'স' হইবে। উপরের বর্ণিত উচ্চারণ থেকেই ইহা সুস্পষ্ট হইবে। সূত্রের প্রয়োজন নাই। (২) বিসর্গের পর শ, ষ, স থাকিতে পারে। এস্থলে সমান শ্রেণীর আওয়াজে মিলিয়া অন্য সন্ধির মত আওয়াজ ডবল হইবে মাত্র, উহার বিকৃতি হইবে না। বিকল্পে বিসর্গ বজায় থাকার নিয়ম, আওয়াজের হিসাবে অর্থশূন্য। এখন বাকি রহিল ব্যঞ্জনের মধ্যে তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম বর্ণগুলি এবং য র ল ব হ। উহাদিগকে গ হ নাম দিয়া অন্যবিধ শ্রেণী বিভাগে ফেলিতেছি। বিসর্গ 'অ'কারের পর, 'আ'কারের পর, অথবা অন্যান্য স্বরের পর থাকিতে পারে; এবং বিসর্গের পর 'অ,' অথবা 'আ,' অথবা অন্যস্বর, অথবা ব্যঞ্জনের তৃতীয় চতুর্থ পঞ্চম বর্ণ ও য র ল ব হ (গ-হ) থাকিতে পারে।

(৩) অর্ব্বাচীন সংস্কৃতের পূর্ব্ববর্ত্তী প্রাকৃতে (অর্থাৎ পালিভাষায়) দেখিতে পাই যে, সকল অকারান্ত শব্দই কর্ত্তৃকারকে বা প্রথমার একবচনে ওকারান্ত হইয়া উচ্চারিত হয়; যেখানে সংস্কৃতের হিসাবে বিসর্গ থাকিবার কথা এবং না থাকিবার কথা, এ উভয় স্থলেই ঐরূপ উচ্চারণ হয়। নরো, নিব্বুতো, ধম্মো, কম্মো ইত্যাদি। একালের প্রাকৃতগুলির মধ্যে কেবল বাঙ্গালায় প্রাচীন প্রাকৃতের ও-ঘেঁষা উচ্চারণ রক্ষিত আছে। পালি উচ্চারণ বৈদিক সময়ের উচ্চারণের অনুরূপ ছিল বলিয়া মনে করিবার অনেক কারণ আছে। সংস্কৃতের ব্যাকরণের নিয়ম অপেক্ষা, পালির ব্যাকরণের অনেক নিয়ম বা রীতি, বৈদিক ভাষার বেশি নিকটবর্ত্তী। বৈদিক ভাষার পরবর্ত্তী ব্রাহ্মণযুগের ভাষার সহিত পালির ব্যাকরণের মিল অতিশয় অধিক। সন্ধির নিয়ম হইতে প্রথমে দৃষ্টান্ত দিতেছি। অথ ঋতু; বৈ ঋচঃ (বৃহদ্দেবতা ২।১৩ ও ১।১৮) প্রভৃতি স্থলে যেমন সন্ধি নাই, পালিতেও তেমনি। দৃশ্যতে + অল্পাঃ = দৃশ্যতেঽল্পাঃ (বৃঃ ১।৮), দ্বে + অনুমতেঃ = দ্বেঽনুমতেঃ (বৃ, ৪।৮৮) প্রভৃতিতে পালির মত নিয়ম রহিয়াছে। তাহার পর শব্দরূপে সুদাঃ শব্দ, পালির মত "সুদাস্" রূপেই লেখা পাই (বৃ, ৬।৩৪)। আবার ওই পালির মত বৃহদ্দেবতা গ্রন্থে চতুসৃভিঃ স্থলে চতুর্ভিঃ, প্রথম পুরুষের তৃতীয়ার একবচনে অনুশাসতি, অসমাপিকাক্রিয়া বুঝাইতে 'য' স্থানে 'ত্বা' এবং 'ত্বা' স্থলে 'য' ইত্যাদি ইত্যাদি পাইয়া থাকি।

এখন যদি উচ্চারণ ধরিয়া বিচার করা যায়, তাহা হইলে এইমাত্র বলা চলে যে, পালির মত যদি অকারান্ত শব্দের ও-ঘেঁষা উচ্চারণ হইবেই (বিসর্গ পরে থাকাতেই হয় ত সেই প্রকার উচ্চারণের সৃষ্টি) তাহা হইলে সর্ব্বত্রই বিসর্গের উচ্চারণের লোপ, এবং ও-কারের উচ্চারণের প্রাধান্য থাকিবে। 'অ' পরে থাকিলে লুপ্তচিহ্ন রাখিবার ব্যবস্থা আছে, তাহাতে স্পষ্ট বুঝিতে পারা যায় যে, কোন অক্ষরই লোপ পায় না; কেবল প্রথম পদে যুক্ত উচ্চারণ টুকুরই তীব্রতার প্রাধান্য থাকে। বিসর্গের পর অকার ভিন্ন স্বরবর্ণ থাকিলে প্রথম শব্দটিতে 'ও' আওয়াজ রাখা অসম্ভব; পূর্ব্বে তাহা অন্য সূত্রের বিচারে বলিয়াছি। তাই সূত্রে কেবল বিসর্গ লোপের ব্যবস্থা আছে। গ-হ ব্যঞ্জন পরে থাকিলেও কেবল ওকার রহিয়া যায়। অর্থাৎ বিশেষ কিছুই হইল না। যেমন ছিল, তেমনি রহিল। ঠিক ঐরূপ আবার আকারের পরে বিসর্গ থাকিলে এবং বিসর্গের পর স্বরবর্ণ এবং গ-হ ব্যঞ্জন থাকিলে কোন সন্ধিই হয় না। বিসর্গের উচ্চারণ ঐ স্থলে বিশেষত্ব পাইয়া ফুটিয়া উঠিতে পথ পায় না; এই পর্য্যন্ত। তাহা হইলে বিসর্গের একটা সন্ধিই রহিল না, অথচ ঐ সন্ধি মুখস্থ করিতেই যত গোল ঘটে।

ক, খ, প, ফ প্রভৃতি পরে থাকিলেও বৈদিকে কোন সন্ধি হইত না; তবে যে সময়ে বিসর্গের প্রাধান্য দেওয়া হইয়াছিল, তখন বিসর্গের মূর্ত্ত উচ্চারণ 'স' রাখিতে হইয়াছে মাত্র। সাধারণ সন্ধির নিয়মে উহাই পাই। কাজেই এখানেও কোন সূত্রের প্রয়োজন হইল না। কয়েকটি বিশেষ দৃষ্টান্ত ছাড়া সর্ব্বত্রই ঐ ষ মূর্দ্ধণ্য। ক, খ, প, ফ পরে থাকিলে কঠোর উচ্চারণই স্বাভাবিক; কিন্তু বিসর্গটি অকারের পরে থাকিলে আওয়াজটি অপেক্ষাকৃত নরম হয় বলিয়া নমস্কার প্রভৃতি শব্দে 'স' উচ্চারিত হয়; অন্য স্থলে মূর্দ্ধন্য ষ হয়।

কিন্তু একটা কথা বুঝিতে পারিতেছি না। কোন একটা বিশেষ রীতিসিদ্ধি (idiomatic use) অনুসারে, অ আ ভিন্ন স্বরবর্ণের পরের বিসর্গের স্থানে প্রাচীন কালে 'র' হইত, দেখিতে পাই। এই নিয়মটি বেদের পদপাঠের প্রতি লক্ষ্য করিলে বৈদিক যুগে ছিল না বলিয়াই মনে হয়। কিন্তু প্রাচীন ব্রাহ্মণ-সাহিত্যের সংস্কৃতে এ সন্ধি আছে। পালিতে আবার এমন অনেক স্থলে সন্ধিতে 'র' আসিয়া উপস্থিত হয়, যেখানে না আছে 'র' না আছে 'র'এর সঙ্গে দূরসম্পর্কযুক্ত অন্য কিছু। তবুও কেন হয়? র পরে থাকিলে বিসর্গ বিকৃতির যে সূত্র আছে, সেইরূপ কার্য্য হইবে বলিয়া আশা করা যাইত; অর্থাৎ বিসর্গের পর একটা কেবল দীর্ঘ উচ্চারণ হইতে পারিত। কেন না ঐস্থলে স্ ও র এর একটা সংযুক্ত কঠোর উচ্চারণ পরিহার করিবার কথা মাত্র। যেমন নীরস, পিতারক্ষ প্রভৃতি হয়, তেমনি যদি নীভয়, নীধন প্রভৃতি হইত, তবে আমাকে মাথা ঘামাইতে হইত না। এখানে রামমাণিক্যের সি, সিজ্, সিম্ মনে পড়িতেছে। যেমনটি চাই, ঠিক তাই ঘটে কৈ? বিসর্গের সন্ধি আদপে নাই বলিয়া খালাসের চেষ্টায় ছিলাম এবং "তো যদুপতে" এবং "স হসতি" বলিয়া আরো দুটি সূত্র ধ্বংস করিতে পারিতাম; কিন্তু দায়ে ঠেকিয়াছি। একটা অনুমানের কথা বলিব। অনুমান অনুমানমাত্র—সিদ্ধান্ত নহে। নিঃ + ভয় প্রভৃতিতে পালি ভাষায়, আমার আশার অনুরূপ ডবল উচ্চারণ (দীর্ঘের প্রকারভেদ মাত্র) হইত। যথা—নিব্‌ভয়, নিদ্‌ধন ইত্যাদি। পালিতে, অর্থাৎ সেকালের সাধারণ কথোপকথনের ভাষায় রেফ্ লোপ করিলেও দীর্ঘ উচ্চারণ হইত; এখনো বাঙ্গালায় উহা প্রচলিত আছে। যথা—ধর্ম্ম স্থলে ধম্ম, কর্ম্ম স্থলে কম্ম ইত্যাদি। হইতে পারে, যে যখন প্রাকৃতকে ঘষিয়া মাজিয়া সাধু বা সংস্কৃত করা হইয়াছিল, তখন সাধারণ একটা নিয়ম বা সূত্রের মধ্যে একচেহারার সকলকে ফেলিবার উদ্যোগে, "ধর্ম্ম" প্রভৃতির Analogyতে নিব্‌ভয় প্রভৃতিকে নির্ভয় করিয়া নূতন সূত্র গড়া হইয়াছিল। আমার অনুমানটি পণ্ডিতসমাজে যদি দৈবাৎ গ্রাহ্য হয়, তাহা হইলেও এক্‌টা খট্‌কা রহিয়া যাইতেছে।

যদি এমন হইত যে, যেগুলি র-জাত বিসর্গ সেইগুলির স্থলেই র হয়, তাহা হইলে সহজ সিদ্ধান্ত হইত। কেন না বৈদিকযুগে র-জাত একটা বিসর্গ নয়; সহজ রকমে র-অক্ষরে হসন্ত উচ্চারণ মাত্র। বৈদিকযুগের বহুপরবর্ত্তী সময়েও পুনর্, প্রাতর্, অন্তর্ প্রভৃতি খাঁজা খাঁজা ব্যবহার হইত; কাজেই সন্ধিতে র জুড়িয়া দিবার সময় বিসর্গের সূত্র ভাবিবার দরকার ছিল না। কিন্তু ব্রাহ্মণযুগের সাহিত্যেই যখন প্রাতর্ প্রভৃতি ছাড়া স-জাত বিসর্গের স্থলে 'র' আগমনের কথা পাই, স্বয়ং পাণিনিকেই যখন বিশেষ সূত্র রচনা করিয়া—অম্লস্, উধস্, অবস্, স্থলে রেফ শুদ্ধ হয়, বলিয়া একটা বিশেষ সূত্র লিখিতে হইয়াছে, তখন আর প্রাকৃত নিয়মের তুড়িতে একটা সূত্রকে উড়াইয়া দিতে পারিলাম না। বিদ্যালয়ের ছাত্রের মুখস্থের জন্য ঐটি জীবিত থাকুক। অন্যগুলির মত একটা উচ্চারণের নিয়মের বশবর্ত্তী করিয়া উহাকে প্রাকৃত আওয়াজ বা শব্দব্রহ্মে বিলীন করিতে পারিলাম না।